মুক্তধারা ডেস্কঃ

৮৪ বছর বয়সে আজ সোমবার (৩১ আগস্ট) মারা গেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিছুদিন আগে দিল্লির বাসভবনে পড়ে মাথায় চোট পান তিনি। এতে তাঁর মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধে। ফলে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচারের আগে জানা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত। তার পরও দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের সেনা হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রপচার করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক ছিল। যেকারণে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ক্রমশই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত আজ মৃত্যুর কাছে হার মানলেন তিনি।

প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য হন তিনি। শিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন পাশ করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে কলকাতায় ডাক বিভাগের পরীক্ষক পদে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ‘দেশের ডাক’ নামে একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন তিনি।

রাজনীতিতে প্রণব মুখোপধ্যায়ের উত্থান হয়েছিল খুব দ্রুতই। ১৯৬৯ সালে মেদিনীপুর উপ-নির্বাচনে তাঁর রণনীতিতে জয়লাভ করেন নির্দল প্রার্থী। এতে ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়েন তিনি। ফলে প্রণব মুখোপধ্যায়কে দলে যোগদান করান ইন্দিরা গান্ধী। সেই বছরই তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর তিনি আরও ৪ বার রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন।

সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রণব মুখোপধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হন। ফলে ১৯৭৩ সালে মন্ত্রিসভায় জায়গা পান তিনি। সে সময় তিনি শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হন। দেশের জরুরি অবস্থাতেও ইন্দিরার পাশে ছিলেন প্রণব মুখোপধ্যায়। ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরলে তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রী হন। ১৯৮০ সালে প্রণব মুখোপধ্যায় রাজ্যসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হন।

ইন্দিরাগান্ধীর হত্যার পর রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মতানৈক্য হয় প্রণব মুখোপধ্যায়ের। ফলে কংগ্রেস থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সময় রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করেন প্রণব মুখোপধ্যায়। তবে তা তেমন সাফল্যের মুখ না দেখায় দল ভেঙ্গে ১৯৮৯ সালে ফের কংগ্রেসে যোগ দেন প্রণব মুখোপধ্যায়।

১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হত্যার পর কংগ্রেসে ফের সক্রিয় হন প্রণব। সেসময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও তাঁকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। পরে পিভি নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর মন্ত্রিসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও দায়িত্ব পান।

১৯৮৫ সালে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০০০ সালে পুনরায় তিনি এ পদ গ্রহণ করেন। পরবর্তী ১০ বছর তিনি কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন।

২০০৪ সালে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসন থেকে জিতে প্রথমবার লোকসভায় যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের লোকসভার নেতা নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হবেন না বলে ঘোষণা করলে প্রণববাবুর নাম নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়। যদিও
শেষ মুহূর্তে মনমোহন সিংয়ের নাম ঘোষণা করেন সোনিয়া।

২০০৭ সাল একই ভাবে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে কংগ্রেসে বেশ আলোচনা হয়। কিন্তু মনমোহন সিং তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যহতি দিতে রাজি ছিলেন না। ফলে সেযাত্রায় রাষ্ট্রপতি হওয়া হয়নি তাঁর।

মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন প্রণব মুখোপধ্যায়। অর্থ, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর ঘোষণা করেন প্রণব মুখোপধ্যায়। পরে কংগ্রেসের পক্ষ হতে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই প্রথম বাঙালি হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রণব মুখোপধ্যায় ‘ভারতরত্ন’ ভূষিত হন।

প্রণব মুখোপধ্যায় দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কখনো দুর্নীতি করেছেন এমন নজির নেই। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সময় দিল্লিতে বাঙালিদের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তবে জননেতা হিসেবে ভারতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। সংসদীয় রাজনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকলেও ২০০৪ সালে তিনি প্রথমবার জনগণের ভোটে জিতে সংসদ যান। তবে মাত্র ২ বার জনগণের ভোটে জিতে সংসদে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।